বিভিন্ন প্রজন্মের মোবাইল ফোন

বিভিন্ন প্রজন্মের মোবাইল ফোন এবং তাদের বৈশিষ্ট্য সমূহ

মোবাইল ফোনের উন্নয়ন ও বিকাশ লাভের জন্য অনেকগুলো ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করতে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের এই মোবাইল ফোনের কার্যক্ষমতা ছিল খুবই কম; দুর্বল নেটওয়ার্কের দরুন সীমিত এলাকাভিত্তিক ব্যবহার হতো।

১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রথম মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু করেন। অতিক্রমের একেকটি ধাপ বা পর্যায় হলো মোবাইল ফোন প্রজন্ম বা জেনারেশন। একেকটি প্রজন্ম পরিবর্তনের সময় কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজিত হয় এবং পুরোনো বৈশিষ্ট্যগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। মোবাইল ফোনের প্রজন্মকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা-

  • প্রথম প্রজন্ম (1st Generation-1G) 1979-1990
  • দ্বিতীয় প্রজন্ম (2nd Generation-2G) 1991-2000
  • তৃতীয় প্রজন্ম (3rd Generation-3G) 2001-2008
  • চতুর্থ প্রজন্ম (4th Generation – 4G) 2009-2020
  • পঞ্চম প্রজন্ম (5th Generation – 4G) 2020- বর্তমান

প্রথম প্রজন্ম (1st Generation-1G : 1979-1990)

যুক্তরাষ্ট্রে সর্বপ্রথম Motorola Dyna TACS (Total Access Communication System নামে হ্যান্ড মোবাইল সেট চালু করে। আশির দশকে প্রথম প্রজন্মের মোবাইল ফোন ছিল সেলুলার নেটওয়ার্কনির্ভর এবং এগুলো অ্যানালগ সিস্টেমের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।

১৯৭৯ সালে জাপানের NTTC (Nippon Telegraph and Telephone Corporation) প্রথম বাণিজ্যিকভাবে অটোমেটেড সেলুলার নেটওয়ার্ক চালু করার মাধ্যমে 1G এর সূচনা করে। নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত এ প্রজন্মের সিস্টেম চলতে থাকে। এই প্রজন্মে রোমিং ব্যবস্থা সীমিত ছিল।

উদাহরণ- AMPS (Advanced Mobile Phone System), TACS (Total Access Communication Suystem) ইত্যাদি।

প্রথম প্রজন্মের মোবাইল সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য

১. অ্যানালগ পদ্ধতিতে রেডিও সিগন্যালের ব্যবহার ছিল
২. সেলুলার নেটওয়ার্কের প্রবর্তন
৩. বেজ স্টেশন ও মোবাইল ফোন দুটি ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হতো
৪. অর্ধপরিবাহী মেমোরি এবং মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার হতো
৫. চ্যানেল অ্যাকসেস পদ্ধতি হলো FDMA
৬. আকার তুলনামূলকভাবে বড় এবং ওজন বেশি ছিল
৭. কথোপকথন চলা অবস্থায় ব্যবহারকারীর অবস্থানের পরিবর্তন হলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো

দ্বিতীয় প্রজন্ম (2nd. Generation-2G : 1991-2000)

১৯৯০ সালে GSM এবং CDMA স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করে দ্বিতীয় প্রজন্মের (2G) মোবাইল সিস্টেমের যাত্রা শুরু হয়। এতে ডিজিটাল ট্রান্সমিশন সিস্টেমের ব্যবহার চালু হয় এবং ভয়েস ও ডেটা প্রেরণ সম্ভব হয়। এজন্য এই প্রজন্মকে ডিজিটাল সেলুলার নেটওয়ার্ক বলা হয়ে থাকে। এ প্রজন্মের মোবাইলে প্রিপেইড পদ্ধতি, এসএমএস, এমএমএস, টেক্সট মেসেজিং ব্যবস্থা সেবা চালু হয়।

উদাহরণ- Digital AMPS, GSM 850/900/1800/1900 ইত্যাদি।

দ্বিতীয় প্রজন্মের মোবাইল সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য

  • ট্রান্সমিশন সিস্টেম ডিজিটাল পদ্ধতি এবং Noise মুক্ত
  • ডেটা আদান-প্রদানে ত্রুটি নির্ণয় ও ত্রুটি সংশোধন হতে থাকে
  • ভয়েস প্রেরণের সুবিধা চালু হয়
  • চ্যানেল অ্যাকসেস পদ্ধতি হলো- FDMA, TDMA ও CDMA
  • মোবাইল ফোনে পেমেন্ট সিস্টেমের প্রবর্তন
  • MMS (Multimedia Message Service), SMS সেবা চালু হয়।
  • আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা এবং মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার সুবিধা ।
  • ডেটার নিরাপত্তার জন্য এনক্রিপশন ব্যবস্থা

তৃতীয় প্রজন্ম (3rd Generation-3G : 2001-2008)

মূলত ডেটা সার্ভিসের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলস্বরূপ সূচনা ঘটে মোবাইলের তৃতীয় প্রজন্ম বা 3G এর। ২০০১ সালে জাপানে এনটিটি ডোকোমো (DoCoMo) WCDMA প্রযুক্তি ব্যবহার করে 3G নেটওয়ার্ক চালু করে।

এ দশকে থ্রিজি প্রযুক্তির মোবাইল টেলিফোনি কমিউনিকেশন্স ৩য় প্রজন্মের মোবাইল ফোনে নিম্নোক্ত ৪টি স্ট্যান্ডার্ড চালু হয়: HSPA – High Speed Package Access WCDMA-Wide band Code-Division Multiple Access UMTS – Universal Mobile Telecommunication System 3GPP – 3rd Gen Partnership Project প্রটোকল High-Speed Downlink Packet Access (HSDPA) চালু হয়।

ফলে তৃতীয় প্রজন্মটি ভাগ হয়ে 3.5G, 3G+ বা turbo 3G নামে পরিচিতি পায়। WCDMA পদ্ধতি পরবর্তীতে UMTS (Universal Mobile Telecommunication System) নামে পরিচিত। 3G তে উচ্চগতির ডেটা ট্রান্সফার ও মাল্টিমিডিয়া ডেটা ব্যবহারসহ CDMA ও GPRS (General Packet Radio Service) স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এই প্রজন্মে ইন্টারনেট, ই-কমার্স, মোবাইল ব্যাংকিং, ভিডিও কল, FOMA (Freedom of Multimedia Access) ইত্যাদি ব্যবস্থা চালু হয়। উদাহরণ- EDGE, HSPA.

তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য

  • ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য সার্কিট সুইচিংয়ের বদলে প্যাকেট সুইচিংয়ের প্রবর্তন
  • ভয়েস ও ডেটা ট্রান্সমিশনের জন্য ডিজিটাল সিস্টেমের ব্যবহার
  • সেল সিগন্যাল এনকোডিং বা চ্যানেল একসেস পদ্ধতি হলো TD-CDMA
  • উচ্চগতির ডেটা স্থানান্তর (2 Mbps বা অধিক) এবং আন্তর্জাতিক রোমিং সুবিধা
  • WCDMA,CDMA2000 1xEV-DO, HSPA, HSDPA, UMTS প্রযুক্তির ব্যবহার বিকাশ লাভ
  • এর ডেটা ট্রান্সফার রেট 2 Mbps-এর বেশি। খুব দ্রুত ছবি ও ভয়েস আদান-প্রদান করা যায় এবং ভিডিও কলের প্রচলন শুরু।

তৃতীয় প্রজন্ম প্রযুক্তির সুবিধা

  • ব্যান্ডউইথ, নিরাপত্তা ও বিশ্বস্ততা বেশি
  • সর্বদা অনলাইনে থাকে। তাই যে কোনো সময় ব্রাউজ করা, ই-মেইল করা এবং তথ্য ডাউনলোড করা যায়
  • ভিডিও কনফারেন্সিং করা যায়
  • সবসময় ইন্টারনেট সংযোগ থাকে, আলাদা করে সংযোগ প্রয়োজন হয় না
  • সমৃদ্ধ মাল্টিমিডিয়া সার্ভিস পাওয়া যায়
  • নির্দিষ্ট (fixed) বা বিভিন্ন রেটে পাওয়া যায়
  • ই-কমার্স মোবাইল ব্যাংকিং প্রভৃতি সুবিধা উপভোগ করা যায়

তৃতীয় প্রজন্ম প্রযুক্তির অসুবিধা

  • ভিন্ন হ্যান্ডসেট প্রয়োজন হয়।
  • সেলুলার অবকাঠামো, বেজ স্টেশন আপগ্রেডিং উচ্চমূল্যে এবং বিদ্যুৎ খরচ বেশি
  • রোমিং এবং ডেটা/ভয়েস একত্রে কাজ করা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি
  • স্পেকট্রাম লাইসেন্স খরচ, নেটওয়ার্ক ডিপ্লয়মেন্ট খরচ অনেক বেশি

৩য় প্রজন্মের মোবাইল ফোনের সাহায্যে ইন্টারনেট ব্রাউজিং ৩য় প্রজন্মের মোবাইল ফোনে ডেটা ট্রান্সফারের জন্য ‘সার্কিট সুইচিং’ পদ্ধতির বদলে ‘প্যাকেট সুইচিং’ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এর ফলে ইন্টারনেটে দ্রুত সংযোগ স্থাপন করা যায় এবং ডেটা ট্রান্সফার স্পিড বা ইন্টারনেট স্পিড বেশি হয়। থ্রিজি প্রযুক্তিকে ‘মোবাইল ব্রডব্যান্ড’-ও বলা হয়। ৩য় প্রজন্মের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সাহায্যে ভিডিও কল এবং মোবাইল টিভি উপভোগ করা যায়।

চতুর্থ প্রজন্ম (4th Generation – 4G : 2009-2020)

ভালো মানের থ্রিজি কভারেজের অভাব থেকেই শুরু হয় চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা। ইন্টারনেটনির্ভর মোবাইল ফোন সিস্টেমে আল্ট্রা-ব্রডব্যান্ড গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাচ্ছে। দ্রুত চলনশীল ডিভাইসে ডেটা স্থানান্তর গতি 100 Mbps, ত্রিমাত্রিক এবং স্থির ডিভাইসের ক্ষেত্রে 1 Gbps পর্যন্ত হতে পারে।

4G এর প্রযুক্তি LTE (Long Term Evolution) স্ট্যান্ডার্ডে কাজ করে থাকে। 4G প্রযুক্তির গতি 3G এর চেয়ে 50 গুণ বেশি। মোবাইল ওয়েব অ্যাকসেস, ভিডিও কনফারেন্সিং, আই.পি টেলিফোন, থ্রিডি টিভি, হাই ডেফিনিশন মোবাইল টিভি, গেমিং সার্ভিসেস ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়। উদাহরণ-WiMAX2.

চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য

  • এ প্রজন্মে সার্কিট সুইচিং বা প্যাকেট সুইচিং-এর পরিবর্তে
  • ইন্টারনেট প্রটোকল (IP) নির্ভর নেটওয়ার্ক ব্যবহার
  • ডেটা ট্রান্সফার রেট বেশি
  • 4G এর গতি 3G এর চেয়ে প্রায় ৫০ গুণ বেশি
  • উচ্চগতির ফ্রিকোয়েন্সি এবং ত্রি-মাত্রিক ছবি প্রদর্শনের ব্যবস্থা
  • বিভিন্ন নেটওয়ার্কের মধ্যে পরিবর্তনের সময় নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ
  • উন্নতমানের মোবাইল টেলিভিশন দেখার উপযোগী

পঞ্চম প্রজন্ম (5th Generation – 5G : 2020)

5G বা পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক সিস্টেম মোবাইল ফোনের মধ্যে অত্যাধুনিক ও সর্বশেষ সংস্করণ। এ ধরনের মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ওয়্যারলেস ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (World Wide Wireless Web) বা সংক্ষেপে wwww নামে পরিচিত।

এই প্রজন্মের মোবাইল ফোনের পারফর্ম্যান্স 4G’র তুলনায় অনেকগুণ বেশি এবং অনেক দ্রুতগতিতে ডেটা ট্রান্সফার করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে 4K টিভি বা ভিডিও (4000 × 2000 পিক্সেল) উপভোগ করা যায়। এ ধরনের মোবাইল ফোনের স্ট্যান্ডার্ডগুলোর মধ্যে 5G NR (New Radio Technology), RAT (Radio Access Technology), MIMO (Multiple Input Multiple Output) অন্যতম।

নকিয়ার মতে, 5G প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 100 – মেগাবিট পর্যন্ত গতি পাওয়া যেতে পারে, যা 4G এর সর্বোচ্চ . গতির চেয়ে চার গুণ দ্রুত। এতে দ্রুত ওয়েবসাইট, অ্যাপ, ভিডিও বার্তা লোড ও আদান-প্রদান করা যাবে।

প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম ২০১৮ সালের অলিম্পিক গেমসে সফলভাবে 5G নেটওয়ার্ক প্রদর্শনে সফলতা দেখিয়েছে। ২০২১ সালে বিশ্বের ৬০টিরও বেশি দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও পরীক্ষামুলকভাবে কয়েকটি স্থানে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বা 5জি সেবা চালু হয়েছে।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *