গ্লোবাল ভিলেজ

গ্লোবাল ভিলেজ কী? প্রযুক্তির যুগে বিশ্বের সংযোগে এর ভূমিকা

গ্লোবাল ভিলেজ: Village বা গ্রাম হলো একটি ছোট গোষ্ঠী অথবা কতকগুলো বাড়ির সমষ্টি। নির্দিষ্ট এলাকায় সীমিত আয়তনে একটি গ্রামের অবস্থান বিধায় গ্রামে বসবাসকারীরা সবাই সবাইকে চিনে। গ্রামে কোনো তথ্য প্রকাশিত হলে মুহূর্তেই তা মুখে মুখে জানাজানি হয়ে যায়। গ্রামে যে কোনো মুহূর্তে একজন আরেকজনের কাজে সহযোগিতা করে থাকে।

‘গ্লোবাল’ শব্দের অর্থ হলো বিশ্ব। গ্লোবাল ভিলেজ অর্থ বিশ্বগ্রাম। গ্লোবাল ভিলেজ হলো প্রযুক্তিনির্ভর একটি বিশ্ব, যাতে বিশ্বের সব দেশ সব জাতি একটি গ্রামের মতো সুবিধা পায়। গ্লোবাল ভিলেজ নিয়ে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হল-

গ্লোবাল ভিলেজ/বিশ্বগ্রামের ধারণা

বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ বলতে সাধারণত এমন একটি ধারণাকে বুঝানো হয়, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন পরস্পরের সাথে সহজ যাতায়াত ও ভ্রমণ, গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত থাকে এবং একক কমিউনিটিতে পরিণত হয়। বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর ব্যাপক ব্যবহার ও প্রভাবের কারণে আজ বিশ্বের কোনো এক দেশের এক প্রান্তের লোকজন অন্য প্রান্তের অন্য কোনো দেশের লোকের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ করতে পারছে।

তথ্যের এ আদান-প্রদান বিশ্বকে এতটাই কাছে নিয়ে এসেছে যে, এটি এখন একটি গ্রাম বা ভিলেজ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- বাংলাদেশে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি এখন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী কোনো ব্যক্তির সাথে তাৎক্ষণিকভাবে অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। টেলিফোন, টেলিভিশন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সহ কিছু ইলেকট্রনিক মাধ্যম এক্ষেত্রে দূরত্বের ব্যবধানটি ঘুচিয়ে দেয়।

বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজে আজকাল বিশ্বের একপ্রান্তের লোক অন্যপ্রান্তের লোকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আজকের বিশ্বে আমরা মূলত একটি বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজেই বসবাস করছি। যোগাযোগ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা, অফিস, বাসস্থান, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সংবাদ, বিনোদন ও সামাজিক যোগাযোগ এবং সাংস্কৃতিক উপাদান বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিশ্বগ্রামের বহুল প্রভাব লক্ষ করা যায়।

কানাডিয়ান দার্শনিক ও লেখক হার্বার্ট মার্শাল ম্যাকলুহান হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজ শব্দটিকে ষাটের দশকে সবার সামনে তুলে ধরে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৯৬২ সালে তাঁর প্রকাশিত ‘The Gutenberg Galaxy: The Making of Typographic Man’ এবং ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘Understanding Media: The Extensions of Man’ বইয়ের মাধ্যমে এ বিষয়টি প্রকাশ করেন।

দ্বিতীয় বইটিতে McLuhan বর্ণনা করেছেন, কীভাবে বৈদ্যুতিক প্রযুক্তি এবং তথ্যের দ্রুত বিচরণ দ্বারা বিশ্ব একটি গ্রাম বা ভিলেজে রূপ লাভ করছে। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি সে সময় ছিল যুগান্তকারী, যেখানে তিনি গ্লোবাল ভিলেজকে একটি ইলেকট্রনিক নার্ভাস সিস্টেম (মিডিয়া) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এবং এটি যে পৃথিবী নামক গ্রহটিকে দ্রুতই সমন্বিত করবে সেটি বুঝিয়েছিলেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন এখন বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।

গ্লোবাল ভিলেজ/বিশ্বগ্রাম এর সংজ্ঞা

বিখ্যাত ওয়েবসাইট yourdictionary অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে- “The definition of a global village is the idea that people are connected by easy travel, mass media and electronic communications, and have become a single community.” “গ্লোবাল ভিলেজ হলো একটি ধারণা, যেখানে মানুষ সহজ যাতায়াত, গণমাধ্যম, ইলেক্ট্রনিক কমিউনিকেশন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত এবং একটি একক কমিউনিটিতে পরিণত হয়।”

MacMillan dictionary অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে- “The modem world which all countries depend on each other and seem to be closer together because of modern communications and transport system.” “একটি আধুনিক দুনিয়া যেখানে সব দেশ একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল এবং আধুনিক যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার মাধ্যমে খুব বেশি কাছাকাছি মনে হয়।”

অক্সফোর্ড আমেরিকান ডিকশনারি অনুযায়ী গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে- “The world considered a single community linked by telecommunications.” উপরের সংজ্ঞাগুলোর আলোকে বলা যায়- গ্লোবাল ভিলেজ হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর এমন একটি পরিবেশ, যেখানে দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করেও পৃথিবীর সকল মানুষ তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্ত থেকে একটি একক সমাজে বসবাস করার সুবিধা পায় এবং একে অপরকে সেবা প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে এমন একটি ধারণা, যেখানে ইলেকট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীটাকেই একটি গ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার উপাদানসমূহ

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবদানে বিশ্বগ্রামের ধারণা সহজেই বাস্তবায়ন ও এর প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। নিচে বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রধান উপাদানসমূহ উল্লেখ করা হলো-

  • ১. হার্ডওয়্যার (Hardware)
  • ২. সফটওয়্যার (Software)
  • ৩. ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি (Connectivity)
  • ৪. ডেটা (Data)
  • ৫. মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা (Capacity)

হার্ডওয়্যার (Hardware)

বিশ্বগ্রামে যে কোনো ধরনের যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হলো উপযুক্ত হার্ডওয়্যার সামগ্রীর। হার্ডওয়্যার বলতে এখানে কম্পিউটার আর এর সাথে যন্ত্রপাতি, মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন, অডিও-ভিডিও রেকর্ডার, স্যাটেলাইট, রেডিও, টেলিভিশন এবং তথ্য ও যোগাযোগ . প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত ডিভাইসসমূহ।

সফটওয়্যার (Software)

বিশ্বগ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য হার্ডওয়্যারের যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সফ্টওয়্যারের। সফ্টওয়্যারের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অপারেটিং সিস্টেম, ব্রাউজিং সফ্টওয়্যার, কমিউনিকেটিং সফ্টওয়্যার এবং প্রোগ্রামিং ভাষা।

ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি (Connectivity)

বিশ্বগ্রামের মেরুদণ্ড হলো নিরাপদভাবে রিসোর্স শেয়ার করার ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি যার মাধ্যমে বিভিন্ন উপাত্ত ও তথ্য প্রতিটি মানুষের নিকট পৌঁছাতে পারে। নিরাপদ তথ্য আদান–প্রদানই হচ্ছে বিশ্বগ্রামের মূল ভিত্তি। নিরাপদ তথ্য প্রদানের জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ইন্টারনেট সংযুক্ততা বা কানেকটিভিটি। এক্ষেত্রে টেলিকমিউনিকেশন, ব্রডকাষ্টিং এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেট কানেকশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

ডেটা (Data)

ডেটা হচ্ছে অগুছালো বা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু তথ্য বা Information। ডেটাকে প্রক্রিয়াকরণ বা প্রসেসিং করে ব্যবহারযোগ্য ইনফরমেশন বা তথ্যে পরিণত করা হয়। বিশ্বগ্রামে বসবাস করতে প্রয়োজন বিভিন্ন তথ্য যা ডেটা থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণ করে পাওয়া যায়। বিশ্বগ্রামে ডেটা ও তথ্যকে মানুষ তার প্রয়োজনে একে অপরের সাথে বিনামূল্যে বা অর্থের বিনিময়ে শেয়ার করতে হয়।

মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা (Capacity)

বিশ্বগ্রামের উপাদানগুলোর মধ্যে মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা অন্যতম। যেহেতু বিশ্বগ্রাম মূলত তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর তাই তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা ও সক্ষমতা ইত্যাদির উপর এর প্রয়োগ নির্ভর করছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবহার করার জ্ঞান না থাকলে এর সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বলা যায় যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান আহরণ বা বিতরণের জন্য এই প্রযুক্তিতে মানুষের জ্ঞান বা সক্ষমতা অত্যাবশ্যক।

গ্লোবাল ভিলেজের সুবিধাসমূহ

  • বিভিন্ন দেশসমূহ এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়
  • ক্লিক করে মুহূর্তেই যে কোন দেশের তথ্য জানা যায়
  • মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যে কোন স্থানের কোন ব্যাক্তির সাথে যোগাযোগ করা যায়
  • মানুষের কাজের দক্ষতা এবং গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে
  • সহজেই বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল জানা যাচ্ছে
  • মুহূর্তেই বিশ্বের যেকোন প্রান্তে ই-মেইলের মাধ্যমে টেক্সট, অডিও এবং ভিডিও আদান-প্রদান করা যায়
  • বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার, ফ্রিওয়্যার, বিনোদন উপকরণ ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে সংগ্রহ করা যায়
  • বিভিন্ন শিক্ষামূলক সাইট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য আহরণ করে জ্ঞানার্জন করা যায়
  • অন-লাইনে যেকোন লাইব্রেরি থেকে বই পড়া যায় এবং ঘরে বসেই বিশ্বের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা গ্রহণ করা যায় ৷
  • টেলিমেডিসিন পদ্ধতিতে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বসে বিশ্বের নামকরা চিকিৎসকদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া যায়
  • ইন্টারনেট টিভি ও ইন্টারনেট রেডিও চালুর ফলে ঘরে বসেই কম্পিউটারে বিভিন্ন ধরনের টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করা যায়
  • ঘরে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকা পড়া যায়
  • ঘরে বসেই পণ্য কেনা বেচা করা যায়। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে এবং লেনদেন সহজ হচ্ছে
  • ওয়েবপেজে একটি বিজ্ঞাপন নিমেষেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া যায়
  • স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ইন্টারনেট নির্ভর অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে সে খবরাখবর জানা যায়
  • ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে উপার্জন করা যায়।

গ্লোবাল ভিলেজের অসুবিধাসমূহ

  • ইন্টারনেট হ্যাকিং করে তথ্য চুরি হয় এবং তথ্যের গোপনীয়তা প্রকাশ পায়
  • অসত্য তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে
  • জনগণ কোনো কিছু পড়ে এর সূত্র যাচাই না করে সত্য বলে গ্রহণ করতে পারে
  • নেটে বেশি সময় দেয়ার কারণে সত্যিকারের বন্ধুর চেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে পারে। এতে করে মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পেতে পারে
  • ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য চুরি
  • ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি হতে পারে
  • পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হওয়া
  • সাইবার আক্রমণ সংঘটিত হওয়া।
  • সহজে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে কোনো দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটা
  • প্রযুক্তির বেশি ব্যবহারের ফলে শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি হওয়া
  • বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়া
  • পৃথিবীর কতিপয় বড় বড় তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি তথ্য নিয়ন্ত্রণ করার ফলে পৃথিবীর ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা
  • ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় অনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটে এবং প্রযুক্তি বৈষম্য সৃষ্টি হয়।

শেষ কথা

বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই গ্রামের অস্তিত্ব লক্ষ করা হয়। কতকগুলো গ্রামের সমন্বয়ে শহর, কতকগুলো শহরের সমন্বয়ে একটি জেলা বা অঞ্চল এবং কতকগুলো জেলা বা অঞ্চলের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি দেশ। আবার অসংখ্য দেশের সম্মিলিত ভৌগোলিক অবস্থানকে বিশ্ব বলে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের পরিধি আজ ছোট হয়ে এসেছে। বৃহৎ প্রেক্ষাপটে সে হিসেবে বিশ্বটাই হলো একটি গ্রাম। অন্যকথায় পৃথিবী একটি একক পরিবার।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *