ব্যান্ডউইথ কী? এটি যেভাবে পরিমাপ করা হয় এবং প্রকারভেদ
আজকে আমরা আলোচনা করব ব্যান্ডউইথ নিয়ে, যা অনেকের কাছে বেশ জটিল মনে হয়। আজকে এই জটিল বিষয়টিকে খুব সহজভাবে উপস্থাপন করবো, যাতে সবাই বুঝতে পারে এবং মনে রাখতে পারে। তাহলে শুরু করা যাক-
সূচিপত্র-
ব্যান্ডউইথ আসলে কি
একক সেকেন্ডে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যে পরিমাণ ডেটা ট্রান্সফার হয়, তাকে অর্থাৎ ডেটা ট্রান্সফারের হারকে ব্যান্ডউইথ বলা হয়। এই ব্যান্ডউইথ সাধারণত Bit per second (bps)-এ হিসাব করা হয় ইন্টারনেটের গতি বা স্পিড তার ব্যান্ডউইথ-এর ওপর নির্ভরশীল। উচ্চ-ব্যান্ডউইথ হলে প্রতি সেকেন্ডে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে বেশি পরিমাণ ডেটা পরিবাহিত হবে। এর ফলে দ্রুতগতির সার্ভিস পাওয়া যায়। যেমন-ছবি বা ভিডিও এর মতো বেশি পরিমাণের ডেটা এক্ষেত্রে তুলনামূলক কম সময়ে ডাউনলোড হবে।
আর ব্যান্ডউইথ কম হলে চ্যানেলের মধ্য দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে পরিবাহিত ডেটার পরিমাণ কম হবে। এর ফলে ছবি বা ভিডিও এর মতো বেশি পরিমাণের ডেটাগুলো আসতে অনেক সময় লাগবে। ব্যান্ডউইথ এবং ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড এ দুটো বিষয় খুবই কাছাকাছি এবং এরা পরষ্পরের সাথে সম্পর্কিত। ব্যান্ডউইথ টার্মটি প্রকৃতপক্ষে নেটওয়ার্কের ক্যাপাসিটি বা সক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
অর্থাৎ ব্যান্ডউইথ দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নেটওয়ার্ক যে পরিমাণ ডেটাকে ট্রান্সমিট করতে পারে, তার পরিমাণকে নির্দেশ করা হয়। অন্যদিকে, ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে ডেটা পাঠানোর গতি বা স্পিডকে বর্ণনা করে। এক কথায় বলতে গেলে, একটি নেটওয়ার্ক কত পরিমাণ ডেটা ট্রান্সমিশন পরিচালনা করতে পারে, সেটি সংজ্ঞায়িত করার জন্য ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হয় আর একটি নেটওয়ার্ক কত দ্রুত ডেটা পাঠাতে পারে তা ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে।

ব্যান্ডউইথ এর ব্যবহার
কোনো কমিউনিকেশনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি এবং মিডিয়ামের ওপর ঐ নেটওয়ার্কের ব্যান্ডউইথ নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ সাধারণ কোনো ইথারনেট ক্যাবলের তুলনায় ফাইবার অপটিক ক্যাবলে অনেক গুণ বেশি ব্যান্ডউইথ পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সাথে প্রয়োজনীয় স্পিড ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করা না হলে প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথ পাওয়া সম্ভব হবে না।
অনেক ব্যবহারকারী যখন একই কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে, তখন ঐ নেটওয়ার্কের ব্যান্ডউইথ সকল ব্যবহারকারীর মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই একজন ব্যবহারকারী বা একটি সার্ভিস যদি ব্যান্ডউইথের বড় একটি অংশ দখল করে রাখে, সেক্ষেত্রে অন্য ব্যবহারকারীদের নেটওয়ার্ক শেয়ার কমে যাবে। এ কারণে দেখা যায় একজন বাড়িতে 1 Mbps ইন্টারনেট লাইন নিয়েছে, কিন্তু ব্যবহারের সময় সে সর্বোচ্চ 128 kbps ব্যান্ডউইথ পাচ্ছে।
অর্থাৎ তার ব্যান্ডউইথ ঐ নেটওয়ার্কের ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং তাদের ব্যবহারের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে। আবার যদি একজন ব্যবহারকারীর কোনো নির্দিষ্ট সার্ভিসের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথ না থাকে, তাহলে তার জন্য ঐ সার্ভিসটির যথাযথ সেবা গ্রহণ করা সম্ভব হবে না । যেমন স্ট্রিমিং মুভির জন্য নির্ধারিত ব্যান্ডউইথ হলো 1.5 মেগাবাইট।
এখন যদি একজন ব্যবহারকারী মোবাইলে 1 মেগাবাইট ব্যান্ডউথের ইন্টারনেট সার্ভিস ব্যবহার করে, তখন সে নেটফ্লিক্স বা এই ধরনের কোনো স্ট্রিমিং প্লাটফরমে অনলাইনে কোনো মুভি দেখতে গেলে মুভিটি স্মুথলি রান করবে না বা মুভিটি রান করার সময় তার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ লো এমন মেসেজ বার বার প্রদর্শন করবে।
বিভিন্ন সার্ভিসের প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথ নিচে উল্লেখ করা হল-
সার্ভিসের নাম | প্রয়োজনীয় ব্যান্ডউইথ |
---|---|
ফোন কল (VolP) | 0.5 Mbps |
ওয়েব ব্রাউজিং | 0.5 – 1.0 Mbps |
স্ট্রিমিং মিউজিক | 0.5 Mbps |
ইমেইল | 0.5 Mbps |
স্ট্রিমিং ভিডিও | 0.7 Mbps |
স্ট্রিমিং মুভি | 1.5 Mbps |
স্ট্রিমিং HD মুভি | 4 Mbps |
ভিডিও কনফারেন্সিং HD | 4 Mbps |
অনলাইন HD মাল্টিপ্লেয়ার গেমিং | 4 Mbps |
ভিডিও কনফারেন্সিং | 1 Mbps |
ইন্টারনেট গেম কনসোল | 1 Mbps |
ব্যান্ডউইথ একক হিসাব
প্রতি সেকেন্ডে একক বিট ডেটা স্থানান্তরিত হওয়ার হারকে bps (bit per second) বলে। তথ্যের ক্ষুদ্রতম একক হলো বিট (Bit)। Bit এর পুরো নাম Bynary Digit। এক বিট সমান বাইনারি তথ্য 0 বা 1 । ৮ বিটে এক বাইট (Byte) সমান এক ক্যারেক্টার। যেহেতু 1 বাইট সমান ৪ বিট, তাই 1 MBps বলতে 8 Mbps বোঝানো হয়।
- bps অর্থ হলো bit per second (1 বিট = 1 বা 0)
- kbps হলো kilobits per second (1000 বিট =1 কিলোবিট)
- Mbps হলো megabits per second (1000 কিলোবিট = 1 মেগাবিট)
- Gbps হলো gigabits per second (1000 মেগাবিট = 1 গিগাবিট)
- Tbps হলো Terabits per second (1000 গিগাবিট =1 টেরাবিট)
- Pbps হলো Petabits per second (1000 টেরাবিট=1 পেটাবিট)
নোট: এখানে MBps দ্বারা মেগা বাইট পার সেকেন্ড এবং Mbps দ্বারা মেগা বিট পার সেকেন্ড বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ বড় হাতের B থাকলে সেটি হবে মেগা বাইট পার সেকেন্ড এবং ছোটো হাতের b থাকলে সেটি হবে মেগা বিট পার সেকেন্ড।
জেনে রাখা প্রয়োজন-
- 1 বাইট (byte) = ৪ বিট (bit) বা 1 ক্যারেক্টার (Character)
- 1 কিলোবাইট (1 KB) = 2° বা 1024 বাইট (byte)
- 1 মেগাবাইট (1 MB) = 2° বা 1024 কিলোবাইট (KB)
- 1 গিগাবাইট (1 GB) = 20 বা 1024 মেগাবাইট (MB)
- 1 টেরাবাইট (1 TB) = 20 বা 1024 গিগাবাইট (GB)
- 1 পেটাবাইট (1 PB) = 2° বা 1024 টেরাবাইট (TB)
ব্যান্ডউইথ এর প্রকারভেদ
ব্যান্ডউইথকে ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড বা ব্যান্ড স্পিডও বলা হয়ে থাকে। এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে যে হারে ডেটা ট্রান্সমিশন বা স্থানান্তর হয়, তাকে ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড বলা হয়)। ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিড-এর একককেও bps (bit per second)-এ হিসাব করা হয়। ডেটা স্থানান্তরের গতির ওপর ভিত্তি করে ডেটা ট্রান্সমিশন স্পিডকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-
- ন্যারোব্যান্ড (Narrowband)
- ভয়েসব্যান্ড (Voiceband)
- ব্রডব্যান্ড (Broadband)
- ওয়াইডব্যান্ড (Wideband)
ন্যারোব্যান্ড (Narrowband)
ন্যারোব্যান্ড সাধারণত ৪৫ থেকে ৩০০ bps পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই ব্যান্ড ধীরগতিসম্পন্ন ডেটা ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। সাধারণত টেলিফোনির ক্ষেত্রে এই ব্যান্ডটির ব্যবহার অধিক লক্ষ করা যায়। টেলিফোনির ক্ষেত্রে ন্যারোব্যান্ড সাধারণত ৩০০ থেকে ৩৪০০ হার্টজ (Hz) ফ্রিক্যুয়েন্সি প্রদান করে থাকে।
যেহেতু শব্দ তরঙ্গ ন্যারো রেঞ্জের ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবাহিত হয়ে থাকে, তাই ন্যারোব্যান্ডকে অডিও স্প্রেকটামের সাথে সমন্বিতভাবে শব্দ ধারণে ব্যবহার করা যায়। এজন্য একে সাব-ভয়েসব্যান্ডও বলা হয়। একসময় টেলিগ্রাফে টেক্সট মেসেজ প্রদানে ন্যারোব্যান্ড ব্যবহৃত হতো।
তবে বর্তমানে তুলনামূলকভাবে খুবই সংক্ষিপ্ত দূরত্বে এবং হাই কোয়ালিটি ভয়েস ডেটা প্রয়োজন নেই এমন যোগাযোগের জন্য ন্যারোব্যান্ড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পুলিশ বা অ্যাম্বুলেন্স পারস্পরিক কমিউনিকেশন, ওয়াকি-টকি, ব্লুটুথ, জিগবি, টু ওয়ে রেডিও ইত্যাদি। ন্যারোব্যান্ড ব্যবহৃত হয় এমন একটি ডিভাইস হলো পেজার (Pager)।
ভয়েসব্যান্ড (Voiceband)
ভয়েসব্যান্ডের গতি সাধারণত 9600 bps পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি সাধারণত টেলিফোনে বেশি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ব্যান্ডে প্রায় 200 থেকে 3600 হার্টজ (Hz) ফ্রিকোয়েন্সিতে তথ্য স্থানান্তর করা যায়। টেলিফোনির ক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি ডিভিশন মাল্টিপ্লেক্সিং-এ সাধারণত 4 কিলোহার্টজ ক্যারিয়ার স্পেসিং ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
কম্পিউটার থেকে প্রিন্টারে, কীবোর্ড থেকে কমপিউটারে অথবা কার্ড রিডার থেকে কম্পিউটারে ডেটা স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও ভয়েসব্যান্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কোনো ডিভাইসের ব্যান্ডউইডথ 1200 bps হতে 9600 bps বা 9.6 kbps পর্যন্ত হলে তা সাধারণভাবে ভয়েসব্যান্ড হিসেবে গণ্য হবে, কেননা ভয়েসব্যান্ডের সীমা 9600 bps হওয়ায় তা প্রায় 9.6 kbps (1 kb = 1000 bits) সমতুল্য হবে।
ভয়েসব্যান্ডকে ভয়েস ফ্রিকোয়েন্সি নামেও অভিহিত করা হয়। আগে ইন্টারনেট একসেস করার জন্য যে ডায়াল-আপ মডেমটি ব্যবহার করা হতো সেটি ভয়েসব্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার। এই ডায়াল-আপ ভয়েসব্যান্ড মডেমগুলোর ব্যান্ডউইডথ 56 kbps.
ব্রডব্যান্ড (Broadband)
উচ্চগতিসম্পন্ন ডেটা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় ব্রডব্যান্ড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ব্রডব্যান্ডে বিস্তৃত ব্যান্ডউইথ এবং অধিক তথ্য বহনের ক্ষমতা থাকে। এ ব্যান্ডের গতি 1 mbps (মেগাবিট/সেকেন্ড) বা এর চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত ডিজিটাল সাবস্ক্রাইবার লাইন বা ডিএসএল, রেডিওলিঙ্ক, অপটিক্যাল ফাইবার, মাইক্রোওয়েভ এবং স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ডেটা স্থানান্তরে এ ব্যান্ড ব্যবহার করা হয়।
ওয়াইডব্যান্ড (Wideband)
ওয়াইডব্যান্ড হলো একটি অধিক বিস্তৃত ফ্রিকোয়েন্সির কমিউনিকেশন চ্যানেল, যা বর্তমানের ক্রমবর্ধমান হাই ডেফিনেশন অডিও ডেটার পরিবহণের চাহিদা মেটাতে তৈরি হয়েছে। এ চ্যানেলের মাধ্যমে অনেক বেশি উচ্চমান সম্পন্ন এবং ক্লিয়ার ভয়েজ বা অডিও ট্রান্সমিট হয়ে থাকে। ওয়াইডব্যান্ড চ্যানেলে ট্রান্সমিট হওয়া ভয়েস বা অডিও ডেটাকে হাই ডেফিনেশন বা এইচডি (HD) অডিও বলা হয়। বর্তমানে ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল বা VOIP কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ওয়াইডব্যান্ড অডিও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এই ছিল ব্যান্ডউইথ নিয়ে আজকের সকল তথ্য উপস্থাপন। কোন এক্সট্রা কিছু জানার প্রয়োজন হলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে, ধন্যবাদ।