ফাইবার অপটিক ক্যাবল

ফাইবার অপটিক ক্যাবল যেভাবে কাজ করে, এর গঠন ও সুবিধা-অসুবিধা

ফাইবার অপটিক ক্যাবল: সিলিকা, কাচ অথবা প্লাস্টিক-এর এক ধরনের পাতলা স্বচ্ছ তন্তু (সুতা) দিয়ে তৈরি যে শক্তিশালী মাধ্যম দিয়ে আলোর গতিতে ডেটা আদান-প্রদান করানো যায়, তাকে ফাইবার অপটিক বা অপটিক্যাল ফাইবার বলা হয়। ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল অত্যন্ত দ্রুত ডেটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার কাজ করে। এ ক্যাবলের বিশেষত্ব হলো, এটি ইলেক্ট্রনিক্যাল সিগন্যালের পরিবর্তে আলোক বা লাইট সিগন্যাল ট্রান্সমিট করে।

আর এ কাজে ব্যবহৃত হয় ফাইবারের অভ্যন্তরে গ্লাস বা প্লাস্টিক কোর। এ ক্যাবলের মাধ্যমে ডেটা আদান-প্রদানের জন্য লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ইনফ্রারেড আলোর রেঞ্জের মধ্যে (1300nm-1500nm) অতিরিক্ত স্বচ্ছ হওয়ার ফলে আলো পরিবহণের সময় এতে কোনো শোষণ হয় না। ফলে বিশেষ কোনো ক্ষতি ছাড়াই এর মধ্য দিয়ে সিগন্যাল দীর্ঘ দূরত্ব পর্যন্ত ট্রান্সমিট করা সম্ভব হয়ে থাকে। (নোট: nm দিয়ে ন্যানোমিটার বোঝানো হয়ে থাকে)

ভেতর দিয়ে অনেক বেশি সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব। এতে একসাথে কয়েক লক্ষ টেলিফোন কল পাঠানো সম্ভব। বিপুল পরিমাণ ডেটা পরিবহণে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আন্তঃমহাদেশীয় ফাইবার অপটিক্যাল স্থাপিত হয়েছে। এ ধরনের ফাইবারকে সাবমেরিন ক্যাবল বলা হয়। নন-মেটালিক ক্যাবল মাধ্যম হলো অপটিক্যাল ফাইবার।

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের গঠন উপাদান

ফাইবার তৈরির অন্তরক পদার্থ হিসেবে সিলিকা এবং মাল্টি কম্পোনেন্ট কাচ বহুলভাবে ব্যবহার করা হয়। এসব অন্তরক পদার্থের গুণগত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- অতি স্বচ্ছতা, রাসায়নিক সুস্থিরতা বা নিষ্ক্রিয়তা এবং সহজ প্রক্রিয়াকরণযোগ্যতা। ফাইবার তৈরির জন্য সোডা বোরো সিলিকেট, সোডা লাইম সিলিকেট, সোডা এ্যালুমিনা সিলিকেট ইত্যাদি মাল্টি কম্পোনেন্ট কাচগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। কখনও কখনও ফাইবারের ক্ল্যাডিং হিসেবে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

বর্তমানে পূর্ণ প্লাস্টিক ফাইবারের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হচ্ছে। অতিরিক্ত ক্ষয় (Loss) হচ্ছে এক্ষেত্রে প্রধান বাধা। সাধারণ কাচ ফাইবার তৈরির জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। কারণ এর মধ্য দিয়ে আলোকরশ্মি কিছুদূর যেতে না যেতেই নিঃশেষ হয়ে যায়। তাছাড়া সাধারণ কাচ দূর থেকে স্বচ্ছ মনে হলেও অপটিক্যাল কমিউনিকেশনের জন্য যতটা স্বচ্ছতা দরকার ঠিক ততটা নয়।

ফাইবার অপটিক ক্যাবল-এর গঠন প্রক্রিয়া

অপটিক্যাল ফাইবারের ৩টি স্তর থাকে। যথা- কোর (Core), ক্ল্যাডিং (Cladding) এবং জ্যাকেট (Jacket)। নিচে বিস্তারিত দেয়া হল-

কোর (Core)

কোর হলো সবচেয়ে ভেতরের স্তর, যার মধ্য দিয়ে আলোক সিগন্যাল সঞ্চালন করে। এই অংশের প্রতিসরাঙ্ক বেশি হয়ে থাকে। এটি সিলিকা মাল্টিকম্পোনেন্ট কাচ বা স্বচ্ছ প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। কোরের ব্যাস ৮ থেকে ১০০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। [১ মাইক্রোমিটার/মাইক্রোন = ১০৬ মিটার]

ফাইবার অপটিক ক্যাবল

ক্ল্যাডিং (Cladding)

কোরকে ঘিরে থাকা বাইরের স্তরটি হচ্ছে ক্ল্যাডিং, যা কাচের তৈরি। এটি কোর থেকে নির্গত আলোকরশ্মি প্রতিফলিত করে তা পুনরায় কোরে ফেরত পাঠায়। এ স্তরটি ক্ল্যাডিং নামে পরিচিত। এই অংশের প্রতিসরাঙ্ক কম হয়ে থাকে। ক্ল্যাডিং-এর ব্যাস ১২৫ মাইক্রোমিটার। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে স্থাপিত আন্তঃমহাদেশীয় ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশনের সাথে ২০০৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সংযুক্ত হয়।

১৬টি দেশ নিয়ে গঠিত SEA-ME- WE4 প্রজেক্টের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সংযোগ পায় এবং বঙ্গোপসাগরের নিচ দিয়ে বিস্তৃত এই ক্যাবলের ল্যান্ডিং স্টেশন তৈরি করা হয় কক্সবাজার শহরে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে প্রাপ্ত হাই স্পিড ইন্টারনেট সারা দেশে ছড়িয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়া হয়। বাংলাদেশে সংযুক্ত এই সাবমেরিন ক্যাবল কানেকশন সাবমেরিন ক্যাবল-১ নামে পরিচিত।

জ্যাকেট (Jacket)

প্রতিটি ক্ল্যাডিং-এর উপর প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো আবরণটিকে জ্যাকেট (Jacket) বলা হয়। এটি ফাইবার অপটিক তারকে ঘর্ষণ, মরিচা, জলীয়বাষ্প থেকে রক্ষা করে। এখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক উপাদানসমূহের মধ্যে রয়েছে PVC (Polyvinyl Chloride), পলিইথিলিন (Polyethylene), পলিইউরেথিন (Polyurethane), পলিয়ামাইড (Polyamide) ইত্যাদি।

ফাইবার অপটিক ক্যাবলে কোর ও ক্ল্যাডিং-এর প্রতিসরাঙ্কের পার্থক্যের কারণে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে কোনো লস ছাড়াই কোরের মধ্য দিয়ে আলো যেতে পারে। ডেটা আদান-প্রদানের জন্য এখানে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এতে ব্যবহৃত কাচের তন্তু অত্যন্ত ভঙ্গুর বলে এটি তৈরির সময়ই পাতলা প্লাস্টিকের আবরণে আবৃত করে নেওয়া হয়। ফাইবার বাঁকা করার কারণে কোনো প্রকার ডেটা লস যেন না ঘটতে পারে, সেজন্য ক্যাবলের মধ্যে একটি সরু রড ঢুকিয়ে রাখা হয়।

বিভিন্ন ধরনের ফাইবার অপটিক

অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যাস প্রায় ১৫০ মাইক্রোন হয়ে থাকে। এর অভ্যন্তরে থাকা কোরের ব্যাস অনুযায়ী ফাইবার অপটিক বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন-

সিঙ্গেলমোড ফাইবার (Singlemode Fiber)

কোরের ব্যাস ৮ থেকে ১২ মাইক্রন হলে সেটিকে সিঙ্গেল মোড ফাইবার বলা হয়। এক্ষেত্রে ফাইবারের কেন্দ্র দিয়ে শুধুমাত্র একটি মোড ট্রান্সমিট হতে পারে। দূরপাল্লার হাইস্পিড ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে সর্বদা সিঙ্গেল মোড ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এতে ব্যবহৃত বিভিন্ন ইকুইপমেন্টগুলো বেশ দামি এবং কোরের ব্যাস অত্যন্ত কম হওয়ায় এই ফাইবারের প্রযুক্তি তুলনামূলক ব্যয়সাধ্য

মাল্টিমোড ফাইবার (Multimode Fiber)

কোরের ব্যাস ৫০ থেকে ১০০ মাইক্রোন হলে উক্ত ফাইবার দিয়ে বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মি পাঠানো যায় এবং একসাথে একাধিক ট্রান্সমিশন হতে পারে। এই ধরনের ফাইবার অপটিককে মাল্টিমোড ফাইবার বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মোড বিভিন্নভাবে যায় বিধায় আলোর সিগন্যাল বিকৃত হয়ে থাকে। স্বল্প দূরত্বে কম স্পিডের ট্রান্সমিশনের ক্ষেত্রে এই ফাইবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোরের ব্যাস বেশি হওয়ায় এর প্রযুক্তি সহজ-সুলভ হয়ে থাকে।

অপটিক্যাল ফাইবারের মধ্য দিয়ে যেভাবে ডেটা পরিবাহিত হয়

অপটিক্যাল ফাইবার কমিউনিকেশনেও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার মতো তিনটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো- প্রেরক যন্ত্র, প্রেরণ মাধ্যম এবং গ্রাহক যন্ত্র। প্রেরক যন্ত্রের মাধ্যমে অ্যানালগ বা ডিজিটাল (ইলেকট্রনিক) সংকেতকে প্ৰয়োজনীয় মডুলেশন করে আলোক তরঙ্গ হিসেবে রূপান্তর করা হয় এবং ফাইবার অপটিকে তা প্রেরণ করা হয়।

ফাইবার অপটিকের মধ্য দিয়ে এই এনকোডেড বা মডুলেটেড আলোকরশ্মি পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে গ্রাহকযন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য পরিবাহিত হয়। অপটিক ফাইবারের একেবারে ভেতরের অংশটি হলো কোর, যা অত্যন্ত স্বচ্ছ কাচ দিয়ে তৈরি। এর প্রতিসরাঙ্ক (Refractive Index) অনেক বেশি থাকে। অন্যদিকে কোরের উপরে যে ক্ল্যাডিং থাকে, তা সাধারণ কাচ বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি, যার প্রতিসরাঙ্ক অনেক কম থাকে।

অপটিক ফাইবারে বেশি প্রতিসরাঙ্কের কোর অংশ থেকে আলো যখন কম প্রতিসরাঙ্কের ক্ল্যাডিং অংশের দিকে গমন করে, তখন তা ক্ল্যাডিং মাধ্যম দিয়ে প্রতিসরিত না হয়ে বরং পূর্ণমাত্রায় প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় কোর অংশে ফিরে আসে। কিন্তু পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের নিয়মানুসারে এটি ততক্ষণে অনেকখানি দূরত্ব (প্রায় ১০ কি.মি) অতিক্রম করে ফেলে।

এভাবেই অপটিক্যাল ফাইবারের মধ্য দিয়ে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে খুব কম লসে ডেটা অধিক পরিমাণ দূরত্বে পরিভ্রমণ করে। এভাবে আলোক সিগন্যাল ফাইবার অপটিক মাধ্যম দিয়ে গ্রাহক যন্ত্রে পৌঁছায়। গ্রাহক যন্ত্রের ফটো ডিটেক্টর এবং প্রসেসিং ইউনিট নামে দু’টো অংশ থাকে। এর মধ্যে ফটো ডিটেক্টরটি ফাইবার অপটিক থেকে ডেটাকে উদ্ধার করে। আর প্রসেসিং ইউনিট ডেটাকে অ্যাম্প্লিফিকেশন, ফিল্টারেশন, ডিমডুলেশন করে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দেয়।

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের বৈশিষ্ট্য

  • ওয়াই-ফাই এর ব্যান্ডউইথ ডাটা ট্রান্সফারে ব্যবহার হয়
  • এর গতি আলোর গতির সমান
  • একসাথে একাধিক তথ্য প্রেরণ করা যায়
  • শক্তির অপচয় হয় না বলা চলে
  • রাসায়নিক নিষ্ক্রিয়তা

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের সুবিধা

  • ডেটা ট্রান্সমিশনের গতি অত্যন্ত বেশি
  • ডেটা ট্রান্সমিশন হার ১০০ Mbps থেকে ২ Gbps
  • নেটওয়ার্ক ব্যাকবোন হিসেবে ব্যবহার করা যায়
  • ক্যাবলের আয়তন কম
  • ডেটা সিগন্যাল পরিবর্তন হয় না এমনকি মানের অবনতি বা এন্টিনিউয়েশন ঘটে না
  • পরিবেশের তাপ, চাপ ইত্যাদি দ্বারা ডেটা আদান-প্রদান বাধাগ্রস্ত হয় না
  • আকারে ছোট এবং ওজন অত্যন্ত কম
  • বিদ্যুৎ চৌম্বক প্রভাব হতে মুক্ত (EMI নেই)
  • অনেক দূরে দূরে রিপিটারসমূহ স্থাপন করতে হয়
  • সহজে প্রক্রিয়াকরণ করা যায়
  • ডেটা সংরক্ষণের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বেশি

ফাইবার অপটিক ক্যাবলে অসুবিধা

  • ইউ (U) আকৃতিতে বাঁকানো যায় না
  • ফাইবার অপটিক অত্যন্ত দামী
  • ফাইবার অপটিক ক্যাবল ইনস্টল করা অন্যান্য ক্যাবলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কঠিন

অপটিক্যাল ফাইবার যোগাযোগ ব্যবস্থা

ফাইবার অপটিক ক্যাবলের উদ্ভব বিপুল পরিমাণ তথ্যের আদান-প্রদানকে প্রচণ্ড গতিশীল করে তুলেছে। ফলে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থায় এসেছে অভাবনীয় সাফল্য। আজকাল বিপুল পরিমাণ উপাত্ত পরিবহণে সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে আন্তঃমহাদেশীয় ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপিত হয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে এ ব্যবস্থাতেও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার মতো তিনটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো- প্রেরক যন্ত্র, প্রেরণ মাধ্যম এবং গ্রাহক যন্ত্র। প্রেরক যন্ত্রের মাধ্যমে অ্যানালগ বা ডিজিটাল সংকেতকে প্রয়োজনীয় মডুলেশন করে আলোক তরঙ্গ হিসেবে রূপান্তর করা হয় এবং ফাইবার অপটিকে তা প্রেরণ করা হয়।

ফাইবার অপটিকে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মাধ্যমে তা গ্রাহকযন্ত্রে পৌঁছায়। গ্রাহকযন্ত্রে ফটো ডিটেক্টর এবং প্রসেসিং ইউনিট নামে দু’টো অংশ থাকে। এর মধ্যে ফটো ডিটেক্টরটি ফাইবার অপটিক থেকে ডেটাকে উদ্ধার কর। আর প্রসেসিং ইউনিট ডেটাকে অ্যাম্পিফিকেশন, ফিল্টারেশন, ডিমডুলেশন করে ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দেয়।

ফাইবার অপটিক ক্যাবল নিয়ে এই ছিল আমাদের আজকের আয়োজন, কোন মতামত, প্রশ্ন অথবা জিজ্ঞাসা থাকলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন, ধন্যবাদ।

বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন:

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *